খুচরা ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং হল এমন এক ধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা যেখানে ব্যাকিং কার্যক্রম সম্পাদিত হয় মূলতঃ মক্কেলের স্বার্থে। উল্লেখ্য যে, মক্কেলকে সামগ্রিক ব্যাংকিং সেবা প্রদানই রিটেইল ব্যাংকিং এর প্রধান বৈশিষ্ট্য । অপর পৃষ্ঠায় বিভিন্ন প্রকারের খুচরা ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং সেবাগুলো পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো ঃ
Table of Contents
খুচরা ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং সেবা [ Retail Electronic Banking ]
স্বয়ংক্রিয় গণনাকারী যন্ত্র (Automated Teller Machine) :
মানি ট্রান্সফার সেবাগুলোর মধ্যে ATM কৌশল সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত জনপ্রিয় মানুষ বিহীন স্বয়ংক্রিয় হিসাব বনকারী এই যন্ত্রের সাহায্যে একজন মলে দিবা-রাত্রির ২৪ ঘণ্টার যে কোন সময় টাকা জমা বা উত্তোলন করতে পারে। এক হিসাব থেকে অন্য হিসাবে টাকা স্থানান্তর, ঋণ পরিশোধ ইত্যাদি কাজ করতে পারে।
এই ধরনের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র প্রতিষ্ঠানের পরিতে, আমানত গ্রহনকারী প্রতিষ্ঠানের বাইরের দেয়াল সংলগ্ন অবস্থায়, এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স, ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা, শপিং সেন্টারে, কারখানা এলাকা ছাড়াও বস্তুতম যে কোন সড়ক ইত্যাদি যে কোন স্থানে স্থাপন করা যায়। ATM সার্ভিস এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো তাদের বিভিন্ন খুচরা সেবাগুলো মক্কেলদের দারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। ফলে মক্কেলদের জন্য যেমন সময় বাঁচে তেমনি সহজতম উপায়ে তারা বিভিন্ন সেবাও পায়। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো মানুষের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম খরচে স্বয়ংক্রিয় এই যন্ত্রের সাহায্যে মক্কেলদের সেবা প্রদান করে তার মুনাফা বৃদ্ধি করেছে।
ATM-এর উদ্দেশ্য (Objectives of ATM) :
ATM পদ্ধতিতে বেশ কিছু উদ্দেশ্য পরিলক্ষিত হয়। এই উদ্দেশ্যগুলোর জন্যই ATM পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। নিম্নে এই উদ্দেশ্যগুলো দেয়া হল:
(১) আভ্যন্তরীন পরিচালনা কয় হ্রাস ও মুনাফা বৃদ্ধি :
আভ্যন্তরীণ পরিচালনা কয় কমিয়ে এবং বাজারে নিজের অংশীদারিত্ব বাড়িয়ে মুনাফা বৃদ্ধি ব্যাংকগুলো কর্তৃক ATM প্রোগ্রাম চালু করার প্রধান উদ্দেশ্য। যেমন: যেখানে খরচ কমানো ব্যাংকের একটি অন্যতম লক্ষ্য সেক্ষেত্রে এমন কোন স্থান যেখানে মক্কেলরা টাকা জমা, উত্তোলন ইত্যাদি খুচরা আর্থিক সেবা পেতে বেশী আগ্রহী, সেসব স্থানে কর্মীবল সহ ব্যাংকিং সুবিধাদি প্রদানে বহু অর্থ খরচ না করে ATM পদ্ধতির মাধ্যমে কোন ব্যাংক খরচ হ্রাস করে মুনাফা অর্জনে সচেষ্ট হয়।
২) দেশে এবং বিদেশে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বাজার সৃষ্টি করা এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা।
৩) অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগে মক্কেলকে উন্নতমানের সেবা প্রদান।
৪) ব্যাংকের গাণিতিক বিশুদ্ধতা নিশ্চিতকরণ।
মক্কেল কিভাবে ATM ব্যবহার করবে ? (How does a Customer Operate ATM ?) :
ব্যাংকগুলো তাদের মক্কেলদের এক ধরনের প্লাষ্টিক কার্ড সরবরাহ করে। প্রতিটি কার্ড-এ নাম্বার, মক্কেলের নাম, স্বাক্ষর ইত্যাদি Magnetic Stripe-এ খোদাই করা থাকে। প্রত্যেকটি মক্কেলকে স্বতন্ত্র্য্য একটি PIN (Personal Identification Number) দেয়া হয়। লেনদেন করার সময় একজন মক্কেল তার কার্ডটি মেশিনের Card Input/readers এ প্রবেশ করায়। তখন ATM মক্কেলকে তার PIN নাম্বার মেশিনে প্রবেশ করাতে বলে।
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (সাধারণতঃ ৩০-৯০ সেঃ) এই PIN নাম্বার মেশিনে দিতে হয়। যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মক্কেল PIN দিতে ব্যর্থ হয় বা ভূল PIN দেয় তবে কার্ডটি মেশিনের মধ্যে আটকা পড়ে যায়। পরবর্তীতে ব্যাংকে গিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে সঠিক নাম্বারসহ পুনরায় কার্ডটি নিতে হয়। যদি যথাযথ PIN দেয়া হয় তবে মেশিন মক্কেলকে জিজ্ঞেস করে কি ধরনের তথ্য বা লেনদেন সে করতে চায়।
যদি মক্কেল টাকা তুলতে চায়, মেশিন তখন নির্দেশ দেয় কত টাকা সে নিতে চায়) মকেলের চাহিদা অনুযায়ী সেই অর্থের পরিমাণ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গাণিতিক নাম্বার সম্বলিত কী বোর্ড এর মাধ্যমে মেশিনকে জানাতে হয়। মেশিনকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের নির্দেশ দিয়ে “Enter Key” তে বা প্রবেশ বোতামটি চাপ দিলে টাকা, কার্ড এবং লেনদেন রশিদ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মেশিন থেকে বের হয়ে আসবে এবং ATM টি পববর্তী লেনদেনের জন্য পুনরায় প্রস্তুত হয়ে থাকবে।
লেনদেন চলাকালীন সময়ের মধ্যে যদি মক্কেল তার লেনদেনের ধরণ পরিবর্তন করতে চায় তবে “Enter Key তে চাপ দেয়ার আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একবার যদি “Enter Key চাপ দেয়া হয়ে যায় তবে লেনদেনের ধরণ আর পরিবর্তন করা যাবে না।”
ATM-এর নিরাপত্তা ব্যবস্থাসমূহ : Security of ATM :
সেবা বিভ্রান্তি ও প্রতারণা এড়ানোর জন্য ATM-এ কিছু নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। নিম্নে এ বিষয়গুলো আলোচনা করা প্রয়োজন-
১) প্রতারণামূলক স্বীকৃতি – (Fradulent authorization) :
সঠিক মক্কেলকে চিহ্নিত করার জন্য ATM পদ্ধতি-এ একটি প্লাষ্টিক কোট কার্ড ও PIN নম্বর ব্যবহার করা হয়। এই জাতীয় পদ্ধতি নির্ভুল নয়। সাধারণত ব্যাংকগুলো ২টি ভিন্ন ভিন্ন Shipment-এ কার্ড ও PIN বিতরণ করে থাকে। এটা একটা ঝুঁকির ব্যাপার। অনেক সময় মক্কেল PIN নম্বর ভুলে যায়, ফলে PIN টি একটি কাগজে লিখে কার্ড- সাথে ম্যানিব্যাগ বা ভ্যানিটিব্যাগে রাখে।
মানিব্যাগ বা ভ্যানিটিব্যাগ হারিয়ে গেলে বা চুরি গেলে প্রাপক বা চোর সহজেই মেশিন থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারে। এছাড়া ইদানিং কালে আসল কার্ডের হুবহু নকল কার্ড তৈরি হচেছ। বর্তমানে Vendorরা নকল কার্ড তৈরি এবং অন্যান্য প্রতারণামূলক বিষয় থেকে বাঁচার জন্যে কিছু নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। এমন একটি কৌশল হল Interleaved পদ্ধতি, যার মাধ্যমে দুই সেট Magenetic Bar Configured করে Plastic Card এর Inner Core এ Print করে দেয়া হয়।
এর সাথে তাপ ও চাপ সংবেদনশীল উপাদান যুক্ত করে দেয়া হয়। ফলে Original Card এর হুবহু নকল কার্ড তৈরি করা যায় না। এছাড়া সঠিক গ্রাহক সনাক্ত করণের জন্য বিভিন্ন কৌশল আবিষ্কার হচেছ। বর্তমানে Voice Identification, Fingureprint সনাক্তকরণ, Hand Patro সনাক্তকরণ, স্বাক্ষর সনাক্তকরণ ইত্যাদির উপর গবেষণা চলছে।
২) তথ্য সংযোগ লংঘন -(Violation of data link) :
অদক্ষ কোন কর্মকর্তা, কর্মচারীর ভুলের কারণে অনেক সময় তথ্য সংযোগ বিচিছন্ন হতে পারে। সুতরাং ATM পদ্ধতি প্রয়োগকারী ব্যাংকসমূহ নিয়মিত ATM মেশিনের কর্মক্ষমতা যাচাই করাসহ বিশ্বস্ত ও দক্ষ কর্মকর্তা/কর্মচারী দ্বারা মেশিন পরিচালনা করা উচিত।
৩) অসং ব্যাংক কর্মকর্তা (Dishonest Personnel) :
অন্য আরেকটি উপায়ে ATM গ্রাহকদের ক্ষতি হতে পারে। অসঙ্গ কাকে কর্মচারী, কর্মকর্তা, মেশিন স্থাপনকারী সভা বা লোক (Serive Engineer) মূল্যবান তথ্য ফাঁস বা বিক্রি করে মরুেলের প্রকৃত ক্ষি করতে পারে। এজন্য বাকের সবসময় এসব কাজে সৎ ও দক্ষ লোক নিয়োগ করা উচিত।
৪) বলপ্রয়োগ-(Physical penetration) :
ATM ভেঙ্গে অর্থ নিয়ে যাবার প্রচেষ্টাও অনেক সময় ঝুঁকির বিবেচনায় আনা হয়। তবে এই ধরনের ঝুঁকির সম্ভাবনা সবচেয়ে কম। একটি ATM-এর সমন্বিত ওজন প্রায় ১.৩৩ টন এবং অত্যন্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থায় দেয়ালের সাথে লাগানো হয়। সাধারনত মেশিনের সাথে একটি Security Alarm লাগানো হয়। কেউ মেশিনটিকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করতে চাইলে বা ক্ষতিসাধন করতে চাইলে Security Alarm বেজে উঠবে।
অর্থনীতিতে ATM (ATM Economics) :
ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে ব্যাংক কর্তৃক ATM পদ্ধতি স্থাপন করার প্রধান উদ্দেশ্য হল লেনদেন খণ্ড (Transaction cost) কমানো এবং বাজারে নিজের ব্যবসায়ীক অংশীদারিত্ব বাড়িয়ে মুনাফা বৃদ্ধি। ATM-এর মূল আকর্ষণ হল ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে Human teller-এর তুলনায় ATM-এ লেনদেন বেশী লাভজনক কিনা। যদিও দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক যুক্তিতে এটা একটা সংকীর্ণ মনোভাব তথাপি ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়নের যুগে ATM Economics কে উপেক্ষা করার কোন উপায় নেই।
আমেরিকায় প্রায় এক দশক পূর্বে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় যে ATM প্রচলিত Human Teller থেকে কেবল দ্রুততরই নয় বরং লাভজনকও। নিম্নোক্ত সারণীর মাধ্যমে প্রতি লেনদেনের ক্ষেত্রে Human teller এবং ATM এর খরচ দেখিয়ে ATM Economics এর বাখ্যা করা যায়।
১. একটি ATM-এর বাৎসরিক খরচ ৩০০০০ ইউ এস ডলার (অবচয়, রক্ষণাবেক্ষণ, Software, ব্যক্তি সহায়তা, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, নিরাপত্তা খরচ ইত্যাদি সহ)
২. প্রতি Human teller এর জন্য প্রতি বরস খরচ ১৮০০০ ইউ এস ডলার (বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদি)
৩. Human teller প্রতি বৎসর যে সংখ্যক লেনদেন করতে পারে = ৩৯৬০০ (গড়ে দিনে ১৫০ টি লেনদেন x ২৬৪ কর্মদিবস)
৪. প্রতি লেনদেনে Human teller বাবদ খরচ = (১৮০০০ : ৩৯৬০০) ইউ এস ডলার = 0.35 ইউ এস ডলার
৫. বিভিন্ন লেনদেন স্তরে ATM-এ প্রতি লেনদেনে খরচ :
গড়ে মাসিক লেনদেন | প্রতি লেনদেনে খরচ |
২000 | ১.২৫ ইউ এস ডলার |
8000 | ০.৬৩ ইউ এস ডলার |
৬000 | ০.৪২ ইউ এস ডলার |
৮000 | ০.৩১ ইউ এস ডলার |
১0000 | ০.২৫ ইউ এস ডলার |
ফলে দেখা যাচেছ যে, প্রতি মাসে একটি ATM-এ ৬০০০ লেনদেন হলে তার বাবদ খরচ একজন Human teller-এর পিছনে প্রতি লেনদেনে যে খরচ হত তার প্রায় সমান। কিন্তু প্রতি মাসে ৬০০০-এর কম লেনদেন হলে ATM-এ প্রতি লেনদেন বাবদ খরচ Human teller বাবদ প্রতি লেনদেনের খরচ এর চেয়ে বেশী হয়েছ। ফলে ATM Economics ঋণাত্মক হবে।
পক্ষান্তরে প্রতিমাসে ৬০০০-এর বেশী লেনদেন হলে ATM Economics ধনাত্মক হবে। কারণ লেনদেন বৃদ্ধির সাথে সাথে ATM-এর প্রতি লেনদেন খরচ কমে যায় । বর্তমানে ATM-এ গড়ে মাসে (প্রায়) ৮০০০ ১০০০০ লেনদেন হচ্ছে। যেহেতু ATM স্থাপনা খরচ দিনে দিনে কমছে, শ্রম কায় বাড়ছে এবং ইতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাবের কারণে ATM-এর ব্যবহার বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান হারে ATM পদ্ধতির প্রসার গ্রাহকদের কাছে ATM পদ্ধতি- এর গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করেছে।
আরও পড়ুনঃ