বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবিরাম অগ্রগতির ফলে আজকের পৃথিবী হয়ে উঠেছে দ্রুতগামী ও সংযুক্ত। প্রাচীনকালে ইতালির লোম্বার্ডি স্ট্রিটের খোলা আঙিনায় যেসব টেবিল-চেয়ার ঘিরে ব্যাংকিং কার্যক্রমের সূচনা হয়েছিল, সেখান থেকে বর্তমান সময়ের ডিজিটাল ব্যাংকিং যুগে পৌঁছাতে banking সেবার বিবর্তন এক মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়েছে।
Table of Contents
ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং কাকে বলে ? [ What is meant by Electronic Banking? ]
ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রাথমিক যুগে হস্তলিখিত হিসাব, ম্যানুয়াল গণনা কিংবা সাধারণ ক্যালকুলেটরের মাধ্যমে কাজ চললেও, সময়ের চাহিদায় এবং প্রযুক্তির প্রসারে তা রূপান্তরিত হয়েছে আধুনিক, দ্রুতগামী ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থায়।
“Promptness is the soul of business.”
— Chesterfield
এই ধারায়, বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তির প্রবেশ এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল। ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল লেনদেনকে দ্রুত ও নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করা। বর্তমানে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে বসেই ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে।
ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং বা ডিজিটাল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে গ্রাহকরা আজ নানা সুবিধা উপভোগ করছেন। চেক বই কিংবা নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি নেই; একটি ছোট্ট প্লাস্টিক কার্ডই এখন বিল পরিশোধ, বেতন গ্রহণ, টাকা উত্তোলন, পেনশন গ্রহণ ইত্যাদি কাজের জন্য যথেষ্ট। ফলে ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং আজ banking খাতে এক অনন্য বিপ্লবের নাম।
ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং-এর সংজ্ঞা
ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং বলতে বোঝায়—কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর এমন একটি আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে গ্রাহক ও ব্যাংকের মধ্যে সরাসরি সাক্ষাৎ ছাড়াই ইলেকট্রনিক মাধ্যম ব্যবহার করে আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করা যায়।
এটি হলো ব্যাংকিং সেবার সেই উন্নত সংস্করণ, যেখানে প্রযুক্তিগত কৌশল ও সফটওয়্যারের সহায়তায় সনাতন ব্যাংকিং সেবাগুলোকে করা হয়েছে আরও সহজ, দ্রুত, নির্ভুল ও নিরাপদ। এটি কেবল একটি বিকল্প নয়, বরং banking সেবা প্রদানের একটি প্রয়োজনীয় ও কার্যকর হাতিয়ার।
ইলেকট্রনিক ব্যাংকিংয়ের বৈশিষ্ট্যসমূহ
নিম্নোক্ত সেবাগুলো ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং-এর আওতাভুক্ত:
-
✅ স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা ও উত্তোলন: ATM/CRM-এর মাধ্যমে ২৪/৭ টাকা লেনদেনের সুবিধা।
-
✅ ফান্ড ট্রান্সফার: এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে টাকা স্থানান্তর করা যায় সহজে ও দ্রুত।
-
✅ বিল ও বেতন পরিশোধ: বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, টেলিফোন বিল কিংবা পে-রোল ব্যবস্থা ইলেকট্রনিকভাবে সম্পন্ন করা যায়।
-
✅ ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড সুবিধা: প্লাস্টিক মানির মাধ্যমে নিরাপদ ক্রয়-বিক্রয়।
-
✅ ই-কমার্স ও অনলাইন লেটার অব ক্রেডিট (LC): ঘরে বসেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক লেনদেন।
-
✅ অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং কার্যক্রম: একাউন্টিং, রেকর্ডকিপিং, রিপোর্টিং ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপে সফটওয়্যারনির্ভর।
প্রযুক্তির প্রভাব
ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং-এর ফলে বর্তমানে ব্যাংকের নানা রকম রেজিস্ট্রার বই, চেক, আবেদনপত্র ও কাগজপত্রের পরিবর্তে ব্যবহার হচ্ছে কম্পিউটার সফটওয়্যার ও প্লাস্টিক কার্ড। প্রতিটি লেনদেন সফটওয়্যারে রেকর্ড হয়ে যায়, যা পরবর্তীতে খুব সহজেই বিশ্লেষণ, অনুসন্ধান এবং রিপোর্ট আকারে উপস্থাপন করা যায়।
এতে শুধু ব্যাংক নয়, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি স্বল্প সময়ে প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে যায়—যা ব্যবসায়িক ও আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক।
বিশেষজ্ঞ মতামত
ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং বিশারদ এলেন এইচ. লিপিস (Ellen H. Lipis) বলেছেন—
“Electronic banking systems are electronic systems that transfer money and record data relating to these transfers.”
তার মতে, ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং হচ্ছে ব্যাংক সেবা প্রদানের একটি ক্রমবিকাশমান ও প্রযুক্তিনির্ভর হাতিয়ার। এটি নতুন কোনও ব্যাংকিং পণ্য নয়, বরং প্রচলিত ব্যাংকিং সেবারই এক নতুন উপস্থাপন ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি।
ভবিষ্যতের দিগন্ত
ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং-এর মাধ্যমেই গড়ে উঠছে এমন এক নতুন আর্থিক বাস্তবতা, যেখানে ব্যাংকার ও গ্রাহকের মধ্যে কাগজপত্র ছাড়াই আর্থিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে—দ্রুততা ও নির্ভুলতা নিশ্চিত করে। এটি শুধু ব্যাংকিং খাত নয়, রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক-সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নীতির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।
ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং হচ্ছে আধুনিক অর্থনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি প্রযুক্তির সহায়তায় ব্যাক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রকে সংযুক্ত করে তুলেছে একটি তড়িৎ-গতি সম্পন্ন আর্থিক জগতে। ভবিষ্যতের ব্যাংকিং যে দিন দিন আরও প্রযুক্তিনির্ভর, কাগজবিহীন এবং সেন্ট্রালাইজড হবে—তা নিঃসন্দেহে অনুমেয়।