আজকের আলোচনার বিষয় ঋণ (Loan) ও বিনিয়োগ (Investment) – দুটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রক্রিয়া, যা ব্যাংক তার তহবিল ব্যবহারের মাধ্যমে পরিচালনা করে থাকে।
ঋণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যাংক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট সুদের বিনিময়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অর্থ প্রদান করে। এভাবে ব্যাংক তাদের মুনাফার উৎস হিসেবে সুদ আয় অর্জন করে।
অন্যদিকে, যখন ব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত ঋণযোগ্য তহবিল থাকে, তখন সেটি মুদ্রাবাজার বা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। এই বিনিয়োগ বিভিন্ন প্রকার ঋণপত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্যান্য আর্থিক দলিল আকারে হতে পারে। এর মাধ্যমে ব্যাংক:
- লভ্যাংশ (Dividend)
- সুদ (Interest)
- বোনাস শেয়ার (Bonus Share)
আদায় করে আয় বৃদ্ধি করতে পারে।
কখনো কখনো, ব্যাংক বিনিয়োগ করা এসব সম্পদ মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করে মূল্যবৃদ্ধিজনিত মুনাফা (Capital Appreciation) অর্জন করতেও সক্ষম হয়।
তবে এই দুটির মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়ে গেছে, যেমন:
পার্থক্যের দিক | ঋণ (Loan) | বিনিয়োগ (Investment) |
উদ্দেশ্য | সুদ আদায় | লাভ, লভ্যাংশ, বোনাস |
ঝুঁকির মাত্রা | তুলনামূলকভাবে কম | তুলনামূলকভাবে বেশি |
আয় নির্ধারিত কিনা | নির্ধারিত সুদ | অনির্ধারিত, বাজার-নির্ভর |
গ্রাহক কে | নির্দিষ্ট ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান | বাজারভিত্তিক প্রতিষ্ঠান |
ফেরতের নিশ্চয়তা | ঋণগ্রহীতার দায়বদ্ধতা | বাজারের গতিপথের উপর নির্ভরশীল |
সুতরাং, ঋণ ও বিনিয়োগ – উভয়ই ব্যাংক আয় বৃদ্ধির দুটি ভিন্ন পথ হলেও, এগুলোর কাঠামো, উদ্দেশ্য ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মধ্যে মূলগত কিছু পার্থক্য বিদ্যমান।
বিভিন্ন সময় ব্যাংক তার বিনিয়োগকৃত সম্পদ, বিশেষ করে দলিলাদির, মূল ক্রয় মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি করে মূল্য বৃদ্ধিজনিত লাভ (Capital Appreciation) অর্জন করে থাকে। তবে, ঋণ (Loan) এবং বিনিয়োগ (Investment)—এই দুটি ব্যাংকিং কার্যক্রমের মধ্যে একাধিক মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান।
নিম্নের সারণীতে ঋণ ও বিনিয়োগের মধ্যকার পার্থক্যসমূহ স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা হলো:
ঋণ বনাম বিনিয়োগ: তুলনামূলক সারণি
ক্র. | পার্থক্যের বিষয় | ঋণ (Loan) | বিনিয়োগ (Investment) |
১ | লেনদেনের ধরন (Transaction Type) | ঋণ লেনদেন | বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালিকানা ভিত্তিক পুঁজি |
২ | যোগাযোগ (Contacts) | প্রত্যক্ষ (Direct) | পরোক্ষ ও অব্যক্তিক (Indirect & Impersonal) |
৩ | মেয়াদকালের জ্ঞান (Knowledge of Maturity) | সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ অবগত | ডিবেঞ্চার ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে অনেকে অবগত নাও থাকতে পারেন |
৪ | মেয়াদকাল (Term) | কয়েকদিন থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত | ব্যাংকের নীতিমালার উপর নির্ভর করে |
৫ | দর কষাকষি (Negotiation) | দর কষাকষিভিত্তিক | সাধারণত দর কষাকষিভিত্তিক নয় |
৬ | তহবিল ব্যবহারের উদ্দেশ্য | ঋণ প্রদানকারী জানে তহবিলের ব্যবহার | দলিল ভিত্তিক বিনিয়োগে ব্যাংক অবগত নাও থাকতে পারে |
৭ | আয়ের উৎস (Income Source) | কেবল সুদ ও দণ্ডসুদ | লভ্যাংশ, বোনাস শেয়ার, মূল্যের বৃদ্ধি, ডিবেঞ্চার থেকে সুদ |
৮ | কার্য আওতা (Operational Scope) | সাধারণত স্থানীয় | জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিস্তৃত |
৯ | ঝুঁকির মাত্রা (Risk Intensity) | মর্যাদা সম্পন্ন গ্রাহক ছাড়া ঝুঁকি বেশি | দলিলভেদে ঝুঁকি ভিন্ন, সাধারণত ঋণের চেয়ে কম |
১০ | তহবিলের পরিমাণ (Volume of Fund) | অধিকাংশ ক্ষুদ্র, ব্যতিক্রম শিল্প ঋণ | সাধারণত বৃহৎ আকারে |
১১ | রূপান্তরযোগ্যতা (Shiftability) | রূপান্তর কঠিন | তুলনামূলকভাবে সহজ |
১২ | অবসায়ন (Termination) | ঋণগ্রহীতার সদিচ্ছায় | শেয়ার/দলিল মালিক বা ব্যাংকের সিদ্ধান্তে নির্ধারিত |
১৩ | হিসাবরীতি (Accounting Treatment) | কোম্পানি বা ব্যক্তির জন্য দায় | কোম্পানির জন্য একটি সম্পদ |
ঋণ এবং বিনিয়োগ—উভয়ই ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক কার্যক্রম হলেও, তাদের কার্যপ্রক্রিয়া, ঝুঁকি, আয় ও রূপান্তরযোগ্যতায় বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ঋণ প্রধানত নির্দিষ্ট সুদে ও নির্দিষ্ট মেয়াদে প্রদান করা হয়, যেখানে বিনিয়োগ সাধারণত মূলধনী বৃদ্ধির সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়।
ব্যাংক ঋণের বৈশিষ্ট্য [ Characteristics of Bank Loan ]
ব্যাংক ঋণ হল ব্যাংকের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ মক্কেল বা গ্রাহকের নিকট প্রদান, যা পরবর্তীতে নির্ধারিত শর্তসাপেক্ষে ফেরত দিতে হয়। উদ্দেশ্য, ব্যবহার এবং গঠন কাঠামোর দিক থেকে ব্যাংক ঋণের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিচে এগুলো সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা হলো:
ক্র. | বৈশিষ্ট্যের নাম | ব্যাখ্যা |
১ | পক্ষসমূহ (Parties) | ঋণগ্রহীতা ও ব্যাংকের মধ্যে লেনদেন সম্পাদিত হয়। |
২ | ঋণের পরিমাণ (Amount) | মক্কেলের প্রয়োজন ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পরিমাণ নির্ধারিত হয়। |
৩ | চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত (Decision) | ঋণ মঞ্জুর বা বাতিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ব্যাংকের; আদালতেও চ্যালেঞ্জযোগ্য নয়। |
৪ | ঋণের মাধ্যম (Mode) | নগদ অর্থ অথবা পণ্য ও সেবার মাধ্যমে (যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ইত্যাদি)। |
৫ | বিতরণের ধরন (Nature) | এককালীন অথবা কিস্তিতে বিতরণ করা হয়। |
৬ | বিতরণ প্রক্রিয়া (Process) | চলতি হিসাবের মাধ্যমে বিতরণ, প্রয়োজনে নতুন হিসাব খুলে। |
৭ | জামানত (Security) | সম্পদ, গ্যারান্টি বা ব্যক্তিগত নিশ্চয়তার ভিত্তিতে প্রদান। |
৮ | ঋণের মূল্য (Loan Pricing) | সুদ, সার্ভিস চার্জ বা অন্যান্য ফি প্রযোজ্য; মক্কেলভেদে হার ভিন্ন হতে পারে। |
৯ | ঋণের মেয়াদ (Tenure) | চাহিবামাত্র, স্বল্প, মধ্যম অথবা দীর্ঘমেয়াদী। |
১০ | ঋণ পরিশোধ (Repayment) | এককালীন বা কিস্তিতে পরিশোধ; নগদ প্রবাহ বিবেচনায় পরিকল্পনা নির্ধারিত। |
বিস্তারিত:
(১) পক্ষসমূহ (Parties Involved)
ব্যাংক ঋণ সাধারণত দুটি পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত হয়—
- প্রথম পক্ষ: ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ ব্যাংক
- দ্বিতীয় পক্ষ: ঋণগ্রহীতা মক্কেল (ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান)মক্কেল আবেদন করলে ব্যাংক সেই আবেদন বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
(২) ঋণের পরিমাণ (Amount of Loan)
ঋণের পরিমাণ নির্ভর করে আবেদনকারীর চাহিদা, তার আর্থিক সক্ষমতা ও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের উপর। ব্যাংক প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই শেষে অনুমোদিত ঋণের পরিমাণ নির্ধারণ করে।
(৩) চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত (Final Decision)
ঋণ মঞ্জুর বা বাতিলের চূড়ান্ত ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে ব্যাংকের হাতে থাকে। মক্কেলের আবেদন ও আলোচনার পরও, ব্যাংক নিজের অর্থায়ন সক্ষমতা, ঝুঁকি বিবেচনা ও মক্কেলের সুনামের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
(৪) ঋণের মাধ্যম (Mode of Loan)
সাধারণত ঋণ নগদ অর্থের মাধ্যমে দেওয়া হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল বা সম্পদ ভাড়ার মাধ্যমে ঋণ দেওয়া হতে পারে (In-kind Loan)।
(৫) বিতরণের ধরন (Nature of Disbursement)
ঋণ সাধারণত এককালীন বা কিস্তি আকারে বিতরণ করা হয়। এটি নির্ভর করে ঋণের ধরণ ও ব্যবহারের উদ্দেশ্যের উপর।
(৬) বিতরণ প্রক্রিয়া (Disbursement Process)
সাধারণত ঋণের অর্থ ব্যাংকের বিদ্যমান চলতি হিসাব (Current Account)-এর মাধ্যমে মক্কেলের নিকট হস্তান্তর করা হয়। নতুন মক্কেল হলে ব্যাংক তাকে একটি চলতি হিসাব খোলার পরামর্শ দেয়।
(৭) জামানত (Security)
ঋণ মঞ্জুরের জন্য সাধারণত জামানত প্রয়োজন হয়। এটি হতে পারে:
- চলতি সম্পদ
- অস্থাবর সম্পদ
- ব্যক্তিগত গ্যারান্টিছোট পরিমাণ ঋণ ক্ষেত্রে শুধু গ্যারান্টিতেই ঋণ মঞ্জুর হতে পারে।
(৮) ঋণের মূল্য (Loan Pricing)
ব্যাংক কখনোই ঋণ বিনা সুদে দেয় না। সাধারণত সুদ, সার্ভিস চার্জ এবং অন্যান্য ফি যুক্ত হয়। সুদের হার নির্ধারিত হয় ঋণের ধরন, ঝুঁকি ও মক্কেলের আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে।
(৯) ঋণের মেয়াদকাল (Periodicity of Bank Loan)
ঋণের মেয়াদ হয় বিভিন্ন রকম:
- চাহিবামাত্র (On demand)
- স্বল্পমেয়াদী (Short-term)
- মধ্যম মেয়াদী (Medium-term)
- দীর্ঘমেয়াদী (Long-term)এটি নির্ভর করে মক্কেলের আর্থিক অবস্থা, প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যাংকের শর্তের উপর।
(১০) ঋণ পরিশোধ (Repayment of Loan)
ঋণ সাধারণত দুইভাবে পরিশোধ হয়:
- এককালীন (Lump sum)
- কিস্তি ভিত্তিক (Installments)পরিশোধ পরিকল্পনা নির্ধারণের সময় ব্যাংক মক্কেলের নগদ প্রবাহ ও আয় সম্ভাবনার বিষয়টি বিবেচনায় রাখে।
ঋণ ও বিনিয়োগ যদিও অর্থায়নের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, তবে তাদের প্রকৃতি, লক্ষ্য ও ঝুঁকি বিবেচনায় অনেকটা ভিন্ন। ঋণ হলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রদানকৃত অর্থ, যার প্রধান উৎস সুদ এবং তা সাধারণত কিস্তিতে ফেরত দিতে হয়। অন্যদিকে, বিনিয়োগ মূলত মালিকানাভিত্তিক অর্থায়ন যেখানে আয়ের উৎস লভ্যাংশ, শেয়ারমূল্য বৃদ্ধি এবং মূলধনী লাভ। ঋণের ক্ষেত্রে ঝুঁকি তুলনামূলক কম থাকলেও বিনিয়োগে ঝুঁকি বেশি এবং তা ব্যাপক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রভাব ফেলে। সফল ব্যবসায়িক ও আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ঋণ এবং বিনিয়োগের এই মৌলিক পার্থক্যগুলো বোঝা অত্যন্ত জরুরি, যা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি উভয়ের জন্যই সঠিক আর্থিক পরিকল্পনার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।