তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা আমাদের আর্থিক লেনদেনকে যেমন সহজ, দ্রুত ও সাশ্রয়ী করে তুলেছে, তেমনি এটি কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ এবং সমস্যার মুখোমুখিও করেছে। বিশেষত, ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং বা ই-ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সমস্যাগুলোর প্রকৃতি কিছুটা ভিন্ন।
Table of Contents
ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং এর সমস্যা (Problems of Electronic Banking)
এই সমস্যাগুলো মূলত দু’টি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়:
(ক) প্রয়োগ জনিত সমস্যাসমূহ (Problems of Application):
ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং একটি অগ্রসর প্রযুক্তি হলেও এর কার্যকর বাস্তবায়নে নানাবিধ সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। এগুলোর মধ্যে গ্রাহকের অবস্থান থেকে শুরু করে নিরাপত্তা, বাজার প্রতিযোগিতা, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, এবং গ্রাহক মনস্তত্ত্ব পর্যন্ত নানা বিষয়ে জটিলতা দেখা দেয়। নিচে এ ধরনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগজনিত সমস্যার বর্ণনা উপস্থাপন করা হলো:
[১] গ্রাহকের অবস্থান ও সক্ষমতা
একটি সাধারণ ধারণা হলো, দরিদ্র ও অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত দেশে ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং সেবা কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে না। যদিও ধারণাটির কিছুটা ভিত্তি রয়েছে, বাস্তবতা বলছে—এটা একেবারে অসার নয়। মাইক্রোক্রেডিট, মোবাইল ব্যাংকিং এবং এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আজ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণও আর্থিক নেটওয়ার্কে যুক্ত হচ্ছেন। প্রযুক্তির সহায়তায় সাশ্রয়ী খরচে উপশাখা স্থাপন এবং উপগ্রহ কেন্দ্রের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় শাখার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্যাংকগুলো দূরবর্তী এলাকার গ্রাহকদের সেবা দিতে পারছে।
[২] বাজার এলাকা, সেবা ও পণ্যের বৈচিত্র্য
ইলেকট্রনিক ব্যাংকিংয়ের সফলতা নির্ভর করে বর্তমান গ্রাহকদের প্রয়োজন ও ভবিষ্যতের প্রযুক্তিগত প্রবণতা কতটা ভালোভাবে অনুধাবন করা হচ্ছে তার ওপর। উন্নত দেশগুলোর বৃহৎ ব্যাংক যেমন Citi Bank বা HSBC বৈশ্বিক পরিসরে উন্নত ই-প্রোডাক্ট চালু করে, যা ছোট বা স্থানীয় ব্যাংকগুলোর জন্য একটি প্রতিযোগিতামূলক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এতে করে বাজার ভাগাভাগি অসম হয়ে পড়ে এবং প্রযুক্তির মানোন্নয়নে বিনিয়োগে সংকটে পড়ে ছোট ব্যাংকগুলো।
[৩] নিরাপত্তাজনিত সমস্যা (Security Issues)
ইলেকট্রনিক ব্যাংকিংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো নিরাপত্তা। হ্যাকার, ডাটা চুরি, বা অপ্রত্যাশিত ট্রান্সফার—এসব বিষয় গ্রাহকের আস্থায় চিড় ধরাতে পারে।
SET (Secure Electronic Transaction) প্রটোকলের প্রচলন এবং শক্তিশালী ক্রিপ্টোগ্রাফিক প্রযুক্তি ব্যবহার যেমন—128-bit বা 256-bit encryption গ্রাহকের তথ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সাহায্য করছে।
উল্লেখযোগ্য একটি উদাহরণ হল, ফ্রান্সের এক ছাত্র মাত্র এক সপ্তাহে প্রায় ৫০টি পেন্টিয়াম কম্পিউটারের সহায়তায় ৪০-বিট SSL প্রোটোকল ভেঙে ফেলেছিল, যা সারা বিশ্বকে নিরাপত্তার প্রশ্নে ভাবিয়ে তোলে। এর ফলস্বরূপ, বর্তমানে উন্নত বিশ্বে ১২৮/২৫৬-বিট এনক্রিপশন ব্যবহৃত হচ্ছে, যা হাজার বছরের চেষ্টাতেও ভাঙা প্রায় অসম্ভব।
[৪] কর্মসংস্থান হ্রাস (Job Displacement)
অনেকের ধারণা, ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং ও অটোমেশনের ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পাচ্ছে। যদিও প্রযুক্তি ব্যবহারে কিছু নির্দিষ্ট পদের প্রয়োজন কমে, তবে সামগ্রিকভাবে এটি ব্যাঙ্কের Productivity ও Profitability বাড়ায়। উপরন্তু, নতুন প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান যেমন—সাইবার নিরাপত্তা, সফটওয়্যার অপারেশন, ও ডেটা অ্যানালিটিক্স-এর জন্য নতুন জনবল নিয়োগের প্রয়োজন দেখা দেয়।
[৫] গোপনীয়তার ঝুঁকি (Privacy Risks)
অনেক সময় দক্ষ সাইবার অপরাধীরা গ্রাহকের লেনদেন সংক্রান্ত স্পর্শকাতর তথ্য হ্যাক করে অর্থনৈতিক অপব্যবহারের আশঙ্কা সৃষ্টি করে। এ ধরনের ঘটনা শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, গ্রাহকের ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে।
[৬] গ্রাহকের মানসিকতা ও রক্ষণশীলতা
বাংলাদেশের মতো দেশে এখনও অনেক গ্রাহক ইলেকট্রনিক ব্যাংকিংয়ের প্রতি আত্মবিশ্বাসী নন। প্রযুক্তি ব্যবহারের ঝুঁকি, প্রতারণার ভয়, এবং প্রচলিত প্রথাগত লেনদেন পদ্ধতির প্রতি নির্ভরতা তাদের রক্ষণশীল করে তুলেছে। এই মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে সময় ও ধারাবাহিক গ্রাহকশিক্ষার প্রয়োজন।
(খ) বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং আরম্ভে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ (Problems of Introducing Electronic Banking in Bangladesh):
বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং সেবা গত এক দশকে কিছুটা প্রসার লাভ করলেও, এখনও তা ব্যাপকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। দেশের কিছু ব্যাংক সীমিত পরিসরে স্বয়ংক্রিয় পশ্চাত অফিস এবং স্বয়ংক্রিয় সম্মুখ অফিস (যেমন: এটিএম, ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড, ইন্টারনেট ও মোবাইল ব্যাংকিং) চালু করলেও সামগ্রিকভাবে ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং এখনও প্রাথমিক স্তরে রয়ে গেছে। গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এ খাতে অগ্রগতির পথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অন্তরায় বিদ্যমান। নিচে সেগুলো ধাপে ধাপে তুলে ধরা হলো:
১. প্রযুক্তি ও জ্ঞানের ঘাটতি
বাংলাদেশের অনেক ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় এখনও কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও সচেতনতা নেই। আধুনিক ব্যাংকিং কার্যক্রমে যেখানে প্রযুক্তিকে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেখানে প্রযুক্তি প্রয়োগে অনীহা ও ভীতি ব্যাংকগুলোর প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২. কৌশলগত পরিকল্পনার অভাব
বেশিরভাগ ব্যাংকের ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং সম্প্রসারণে কোনো সুপরিকল্পিত স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান নেই। উপরন্তু, অনেক ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের ব্যবস্থাপক ও পরিচালকদের এ বিষয়ে আগ্রহ ও অগ্রাধিকারও খুব সীমিত।
৩. দুর্বল যোগাযোগ অবকাঠামো
দেশে এখনো উন্নত আন্তঃজেলা টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা, ওয়াইড এরিয়া নেটওয়ার্ক (WAN) বা রিয়েল টাইম অনলাইন ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক নেই। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শাখাগুলো কেন্দ্রীয় সার্ভারের সাথে দ্রুতগতিতে সংযুক্ত হতে পারছে না, যা ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং বাস্তবায়নে বড় অন্তরায়।
৪. প্রযুক্তিবিদদের বেতন ও সুবিধার ঘাটতি
কম্পিউটার প্রযুক্তি ও সফটওয়্যার সেবা প্রদানকারীদের জন্য উপযুক্ত বেতন-ভাতা ও প্রণোদনা না থাকায় অনেক দক্ষ কর্মী বিদেশে চলে যাচ্ছেন। ফলত, ব্যাংকগুলো দক্ষ জনবল সংকটে ভুগছে।
৫. অপরিকল্পিত বাজেট ও বিনিয়োগ
অনেক ব্যাংক পরিকল্পিত বাজেট বরাদ্দ ছাড়াই কম্পিউটারাইজড সেবা চালু করেছে। ফলে কাঙ্ক্ষিত পশ্চাত অফিস এবং সম্মুখ অফিস সেবা পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং বিস্তারে একটি সুনির্দিষ্ট, সময়োপযোগী এবং ধাপে ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট পরিকল্পনা অপরিহার্য।
৬. কেন্দ্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব
বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয় না থাকায় সমন্বিত আর্থিক অবকাঠামো তৈরি সম্ভব হচ্ছে না। এটি ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
৭. আধা-স্বয়ংক্রিয় ক্লিয়ারিং হাউস
বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্লিয়ারিং হাউস এখনও আধা-স্বয়ংক্রিয়, যা পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় হলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আরও দ্রুত এবং নিরাপদে স্বয়ংক্রিয় পশ্চাত অফিস ও সম্মুখ অফিস কার্যক্রম প্রসারিত করতে পারবে।
৮. দুর্বল ও অপূর্ণাঙ্গ ব্যাংকিং সফটওয়্যার
বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে তৈরি ব্যাংকিং সফটওয়্যার প্যাকেজগুলো সনাতন পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠলেও, এখনও তারা ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং-এর পূর্ণ পরিসরে কার্যকর হতে পারছে না। গ্রাহক ও ব্যাংক উভয়ের চাহিদা অনুযায়ী এমন সফটওয়্যার দরকার, যা একই প্ল্যাটফর্মে হিসাব খোলা থেকে শুরু করে ক্লিয়ারিং, লোন অ্যাপ্লিকেশন, ট্রেড ফাইন্যান্স ও কর্পোরেট সার্ভিস—সবকিছু পরিচালনা করতে সক্ষম।
৯. আইনগত কাঠামোর সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশে এখনও পূর্ণ অর্থে টাকা রূপান্তরযোগ্য নয়, যার ফলে আন্তর্জাতিক অনলাইন ব্যাংকিং সেবা বা ইন্টার-কান্ট্রি ফান্ড ট্রান্সফার বাধাগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি, দেশের সাইবার আইন ও ইলেকট্রনিক ট্রান্সঅ্যাকশন সংক্রান্ত আইনি কাঠামো এখনও অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল ও অসম্পূর্ণ।
ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং আধুনিক আর্থিক সেবাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলেও, এর কার্যকর বাস্তবায়নের পথে এখনো বহু সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে—বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে। একদিকে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি ব্যবস্থার অগ্রগতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও গ্রাহকসেবার নতুন নতুন দিক খুলে দিচ্ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশে এখনো রয়েছে অবকাঠামোগত দুর্বলতা, জনবল সংকট, প্রযুক্তি-জ্ঞানসম্পন্ন নেতৃত্বের অভাব, আইনি সীমাবদ্ধতা ও নেটওয়ার্ক ঘাটতির মতো মৌলিক সমস্যা।
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ব্যাংকিং খাতের প্রতিযোগিতা ও টিকে থাকার জন্য ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং চালু ও সম্প্রসারণ অপরিহার্য। তবে এর জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা, কারিগরি দক্ষতা, সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ, এবং সর্বোপরি সরকারের প্রণীত একটি আধুনিক ও বাস্তবভিত্তিক নীতিকাঠামো।
সুতরাং, এই সমস্যাগুলোর যথাযথ সমাধান ও প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া ইলেকট্রনিক ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা যেমন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে না, তেমনি এর ঝুঁকিগুলোও ভবিষ্যতে আরও গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। সময় এসেছে, এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে একটি ডিজিটাল, সুরক্ষিত এবং কার্যকর ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার।