বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সাম্প্রতিক সময়ে একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে উঠে এসেছে Loan Default Culture বা ঋণ খেলাপ সংস্কৃতি। এর মূলে রয়েছে একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা—“যত পারো ঋণ নাও, ফেরত দিও না।”
এই সংস্কৃতি ব্যাংক খাতে নানামুখী সমস্যার সৃষ্টি করেছে:
- অনেক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
- ব্যবস্থাপনার দক্ষতা হ্রাস পেয়েছে।
- মুনাফার হার শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে।
- কিছু ব্যাংক দেউলিয়াত্বের মুখোমুখি।
অথচ খেলাপি ঋণের উপরে অর্জিত কিন্তু আদায় না হওয়া সুদের ভিত্তিতে কিছু ব্যাংক এখনও বোনাস ও ভাতা দাবি করছে, যা একটি অস্বচ্ছ আর্থিক চিত্র তৈরি করছে।
Table of Contents
ঋণ শ্রেণী বিন্যাসের সূচনা
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম ১৯৮৯ সালে BCD সার্কুলার নং ৩৪ এর মাধ্যমে ঋণ শ্রেণী বিন্যাসের নীতিমালা চালু করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল—
- ব্যাংকসমূহের খেলাপি ঋণ চিহ্নিতকরণ।
- এ সকল ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন (Provision) সংরক্ষণ।
- আর্থিক অবস্থার স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
পরবর্তীতে এটি আরও সহজীকরণ ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আনার জন্য ১৯৯৮ সালে BRPD সার্কুলার নং ১৬ এর মাধ্যমে নতুন পদ্ধতি চালু হয়।
ঋণ শ্রেণী বিন্যাসের ধরণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, সব ব্যাংক ঋণকে চারটি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে:
শ্রেণী | ইংরেজি নাম | সংজ্ঞা | উদাহরণ |
(ক) চলমান | Continuous Loans | নির্ধারিত ঋণসীমা আছে, নির্দিষ্ট পরিশোধ সূচী নেই। | ক্যাশ ক্রেডিট, ওভারড্রাফট |
(খ) তলবী | Demand Loans | নির্দিষ্ট অংকের ঋণ, চাহিবা মাত্র পরিশোধযোগ্য। | ফরসড লিম, PAFBP, IBP |
(গ) মেয়াদী | Fixed Term Loans | নির্ধারিত মেয়াদ ও পরিশোধ সূচী রয়েছে। | সকল মেয়াদী ঋণ |
(ঘ) স্বল্পমেয়াদী কৃষি | Short-Term Agricultural Loans | কৃষিখাতে প্রদত্ত ≤১২ মাস মেয়াদি ঋণ। | মাইক্রোক্রেডিট, স্বনির্ভর প্রকল্প |
ঋণের মান ও প্রভিশন হার
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় ঋণসমূহকে আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে তিনটি মানে শ্রেণীভুক্ত করা হয় এবং প্রত্যেকটির জন্য নির্দিষ্ট হারে প্রভিশন রাখা বাধ্যতামূলক:
ঋণের মান | প্রভিশন হার |
নিম্নমান (Substandard) | ২০% |
সন্দেহজনক (Doubtful) | ৫০% |
মন্দ (Bad/Loss) | ১০০% |
১. ঋণ শ্রেণী বিন্যাসের মাপকাঠি
ঋণ শ্রেণী বিন্যাসের জন্য মূলত দুটি মাপকাঠি অনুসরণ করা হয়:
- বস্তুগত মাপকাঠি (Objective Criteria)
- গুণগত মান (Qualitative Judgement)
১. বস্তুগত মাপকাঠি (Objective Criteria)
এটি মূলত ঋণের পরিশোধ সময়সীমা, নবায়ন, কিস্তির খেলাপি পরিমাণ ইত্যাদি সময়ভিত্তিক বিষয়াবলির ওপর নির্ভর করে। নিম্নে বিভিন্ন ধরণের ঋণের শ্রেণীবিন্যাসের বিস্তারিত টেবিল দেওয়া হলো:
ক) চলমান ও তলবী ঋণের ক্ষেত্রে শ্রেণীবিন্যাস
অনিয়মিত সময়সীমা | শ্রেণী |
৩ মাস বা ততোধিক, কিন্তু ৬ মাসের কম | নিম্নমান (Substandard) |
৬ মাস বা ততোধিক, কিন্তু ১২ মাসের কম | সন্দেহজনক (Doubtful) |
১২ মাস বা ততোধিক | মন্দ/অপূরণীয় (Bad/Loss) |
খ) মেয়াদী ঋণের কিস্তি খেলাপির ভিত্তিতে শ্রেণীবিন্যাস
মেয়াদ ≤ ৫ বছর
কিস্তি খেলাপির পরিমাণ | শ্রেণী |
৬ মাসের কিস্তির সমান বা অধিক | নিম্নমান (Substandard) |
১২ মাসের কিস্তির সমান বা অধিক | সন্দেহজনক (Doubtful) |
১৮ মাসের কিস্তির সমান বা অধিক | মন্দ (Bad/Loss) |
মেয়াদ > ৫ বছর
কিস্তি খেলাপির পরিমাণ | শ্রেণী |
১২ মাসের কিস্তির সমান বা অধিক | নিম্নমান (Substandard) |
১৮ মাসের কিস্তির সমান বা অধিক | সন্দেহজনক (Doubtful) |
২৪ মাসের কিস্তির সমান বা অধিক | মন্দ (Bad/Loss) |
গ) স্বল্পমেয়াদী কৃষি ও ক্ষুদ্র ঋণের ক্ষেত্রে
অনিয়মিত সময়সীমা | শ্রেণী |
১২ মাস অতিক্রান্ত | নিম্নমান (Substandard) |
৩৬ মাস অতিক্রান্ত | সন্দেহজনক (Doubtful) |
৬০ মাস অতিক্রান্ত | মন্দ (Bad/Loss) |
২. গুণগত মান (Qualitative Judgement)
যে ঋণসমূহ বস্তুগত মানদণ্ডে শ্রেণীবিন্যাসযোগ্য না হলেও কিছু পরিস্থিতিতে গুণগতভাবে শ্রেণী বিন্যাস করতে হয়। এই পরিস্থিতিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- ঋণ আদায়ে অনিশ্চয়তা বা সন্দেহ
- জামানতের মূল্য হ্রাস
- প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ঋণগ্রহীতার মূলধনের ক্ষতি
- অনুচিত পুনঃতফসিলায়ন
- ঋণের সীমা বারংবার অতিক্রম
- মামলার কারণে আদায়ের জটিলতা
- অনুমোদনহীন ঋণ প্রদান
২. গুণগত মানের ভিত্তিতে শ্রেণীবিন্যাস
মূল্যায়ন | শ্রেণী |
উপযুক্ত পদক্ষেপে আদায়ের সম্ভাবনা | নিম্নমান (Substandard) |
পদক্ষেপে পূর্ণ পরিশোধের সম্ভাবনা নেই | সন্দেহজনক (Doubtful) |
সর্বোচ্চ প্রচেষ্টাতেও আদায়ের সম্ভাবনা নেই | মন্দ (Bad/Loss) |
বি.দ্র.: বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকদল কর্তৃক শ্রেণীবিন্যাস হলে তা চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি ছাড়া তা পুনঃশ্রেণীবিন্যাস (Declassify) করা যাবে না।
৩. শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের সুদ হিসাবায়ন:
১. নিম্নমান ও সন্দেহজনক ঋণ:
- এই ধরনের ঋণের উপর সুদ আরোপ করা গেলেও, সেটি আয় হিসেবে গণ্য করা যাবে না।
- আরোপিত সম্পূর্ণ সুদকে “স্থগিত সুদ (Interest Suspense)” হিসাবে সংরক্ষণ করতে হবে।
২. মন্দ ঋণ:
- ঋণ মন্দ শ্রেণিতে পড়লেই সুদ আরোপ স্থগিত রাখতে হবে।
- তবে মামলা দায়েরের উদ্দেশ্যে মামলার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত সুদ আরোপ করা যেতে পারে। এই সুদও “স্থগিত সুদ” হিসেবে বিবেচিত হবে।
- অন্যান্য কোনো কারণে মন্দ ঋণ হলে, তাও একইভাবে স্থগিত সুদ হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে।
৩. আদায় সংক্রান্ত বিধান:
- শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণ বা তার কোনো অংশ আদায় হলে, আগে স্থগিত সুদ এবং আরোপিত সুদ আদায় করতে হবে, এরপর মূল অর্থ (principal) সমন্বয় করতে হবে।
৪. প্রভিশন সংরক্ষণ:
(ক) সাধারণ ঋণের প্রভিশন হার:
ঋণের শ্রেণী | প্রভিশনের হার (%) |
নিম্নমান (Sub-standard) | ২০% |
সন্দেহজনক (Doubtful) | ৫০% |
মন্দ (Bad/Loss) | ১০০% |
প্রভিশন গণনার সময় শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের বকেয়া স্থিতি থেকে:
- স্থগিত সুদ
- উপযুক্ত জামানতের মূল্য
বিয়োজন করতে হবে।
- অশ্রেণীবিন্যাসিত (Regular) ঋণ এর বিপরীতে ১% হারে সাধারণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে।
(খ) উপযুক্ত জামানতের সংজ্ঞা:
জামানতের ধরণ | গ্রহণযোগ্য মূল্যায়ন হার |
ঋণের বিপরীতে লিয়েনকৃত আমানত | ১০০% |
গচ্ছিত স্বর্ণ বা স্বর্ণালংকার (বাজারমূল্যে) | ১০০% |
সরকারী বন্ড/সার্টিফিকেট (লিয়েনকৃত) | ১০০% |
সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক প্রদত্ত গ্যারান্টি | ১০০% |
সহজে বিপণনযোগ্য পণ্য (ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে) | ৫০% |
জামানতকৃত জমি/ইমারতের বাজার মূল্য | সর্বোচ্চ ৫০% |
(গ) স্বল্পমেয়াদী কৃষি ও ক্ষুদ্র ঋণ:
ঋণের ধরণ | প্রভিশনের হার (%) |
সন্দেহজনক, নিম্নমান, অনিয়মিত ও নিয়মিত ঋণ | ৫% |
মন্দ ঋণ | ১০০% |
৫. শ্রেণীবিন্যাস কার্যক্রম ও তদারকি:
- ব্যাংকসমূহ ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ঋণ শ্রেণীবিন্যাস কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
- সূত্র তারিখের ৩০ দিনের মধ্যে শ্রেণীবিন্যাস, প্রভিশন, ও স্থগিত সুদ সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হবে।
- এই নীতিমালা ১৯৯১ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে।
- বাংলাদেশ ব্যাংক “On-site” ও “Off-site Supervision” এর মাধ্যমে এই নীতিমালার মনিটরিং ও কার্যকারিতা পর্যালোচনা করছে।