[ADINSERTER AMP] [ADINSERTER AMP]

সমস্যাগ্রস্ত/দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ কি? [ What is Problem / Distressed Loans? ]

সমস্যাগ্রস্থ ঋণ ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্যের জন্য এক ধরনের দীর্ঘস্থায়ী রোগ। যেমন একজন রোগী অসুস্থ হলে পরিবার ও চিকিৎসক মিলে রোগ সারানোর চেষ্টা করেন এবং রোগীকে ত্যাগ করেন না, তেমনি ব্যাংকের ক্ষেত্রেও যদি সমস্যাগ্রস্থ ঋণকে প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তাহলে অনেক ঋণকে অকর্মণ্য ঋণ (Non-Performing Loan – NPL) বা কুঋণে (Bad Loan) পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব।

 

সমস্যাগ্রস্থ ঋণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

  1. সতর্ক ঋণগ্রহীতা নির্বাচন
    • ঋণ দেওয়ার আগে ঋণগ্রহীতার ব্যক্তিগত সুনাম, আর্থিক স্থিতি, ব্যবসার সম্ভাবনা, পূর্ববর্তী ঋণ পরিশোধের ইতিহাস, এবং জামানতের মান বিশদভাবে মূল্যায়ন করতে হবে।
    • প্রয়োজন হলে বাজার গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রাহকের ব্যবসায়িক সুনাম যাচাই করতে হবে।
  2. নিয়মিত ঋণ তদারকি পুনঃনিরীক্ষণ
    • ঋণ বিতরণের পর নির্দিষ্ট সময় অন্তর আর্থিক প্রতিবেদন, নগদ প্রবাহ (Cash Flow), এবং ব্যবসার অগ্রগতি পর্যালোচনা করা।
    • ঋণ পরিশোধ প্রবণতা এবং তারল্যের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা।
  3. সমস্যার প্রাথমিক সতর্ক সংকেত শনাক্তকরণ
    • সময়মতো কিস্তি পরিশোধ না করা।
    • বারবার সময় বৃদ্ধির আবেদন করা।
    • ব্যবসার আয় হ্রাস পাওয়া বা বাজারে নেতিবাচক গুজব ছড়ানো।
    • ঋণগ্রহীতার হঠাৎ করে যোগাযোগে অনীহা প্রকাশ বা লেনদেনের স্বচ্ছতা কমে যাওয়া।
  4. ঝুঁকি প্রশমন পদক্ষেপ
    • প্রয়োজনে ঋণ পুনর্গঠন (Restructuring), পুনঃতফসিলীকরণ (Rescheduling), বা জামানত বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্থ পুনরুদ্ধার।
    • উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের জন্য বিশেষ পর্যবেক্ষণ ইউনিট গঠন।

যে ব্যক্তি ঋণ নিয়ে তা ফেরত দেওয়ার ইচ্ছা রাখে না, সে চোরের সমান।”
আল-হাদিস

 

সমস্যাগ্রস্থ ঋণের সংজ্ঞা

ব্যাংকের ঋণ সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত:

  1. আদর্শ ঋণ (Standard Loan) – নির্ধারিত সময়সূচি ও শর্ত অনুযায়ী ফেরত পাওয়া যায়।
  2. সমস্যাগ্রস্থ ঋণ (Problem/Distressed Loan) – নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী আদায় হয় না এবং পরিশোধে অনিয়ম দেখা যায়।

লেখকের মতে:

“Problem Loans refer to those which the borrowers do not return as and when required, in spite of repeated reminders, and are not able to show any acceptable reasons for such failure.”
অর্থাৎ— সমস্যাগ্রস্থ ঋণ হল সেই সব ঋণ, যা বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও ঋণগ্রহীতা ফেরত দেয় না অথবা ফেরত না দেওয়ার জন্য যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য কারণ দেখাতে ব্যর্থ হয়।

 

কেন সব ঋণ সমস্যাগ্রস্থ হয় না?

সব ঋণ আদর্শ হয় না, আবার সব ঋণ সমস্যাগ্রস্থও নয়। ঋণগ্রহীতাদের অনেকেই ঋণ নেওয়ার সময়ে—

  • ফেরত দেওয়ার সদিচ্ছা এবং
  • আর্থিক সক্ষমতা
    দুটিই রাখেন।

তবে সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হতে পারে:

  • সদিচ্ছা হ্রাস – ইচ্ছাকৃতভাবে পরিশোধ না করার প্রবণতা গড়ে ওঠা।
  • ক্ষমতা হ্রাস – ব্যবসায় লোকসান, বাজারের মন্দা, বা ব্যক্তিগত আর্থিক বিপর্যয়ের কারণে পরিশোধে অক্ষম হওয়া।
  • উভয়ের অবনতি – অর্থাৎ ইচ্ছা ও ক্ষমতা উভয়ই নেতিবাচকভাবে পরিবর্তিত হওয়া।

উদাহরণ:

  • একজন ব্যবসায়ী, যিনি মূলত সৎ ছিলেন, কিন্তু বৈদেশিক বাজারে অপ্রত্যাশিত লোকসানের কারণে ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়েছেন।
  • একজন গ্রাহক, যার ব্যবসা সচল থাকলেও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে ঋণ ফেরত না দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে।

 

সমস্যাগ্রস্থ ঋণের ধরন অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাস

  1. ঋণ ফেরৎ দেওয়ার ইচ্ছা + ঋণ ফেরৎ দেওয়ার সামর্থ্য = আদর্শ ঋণ
  2. ঋণ ফেরৎ দেওয়ার অনিচ্ছা + ঋণ ফেরৎ দেওয়ার সামর্থ্য = সমস্যাগ্রস্থ ঋণ
  3. ঋণ ফেরৎ দেওয়ার ইচ্ছা + ঋণ ফেরৎ দেওয়ার অসামর্থ্য = সমস্যাগ্রস্থ ঋণ
  4. ঋণ ফেরৎ দেওয়ার অনিচ্ছা + ঋণ ফেরৎ দেওয়ার অসামর্থ্য = সমস্যাগ্রস্থ ঋণ

 

বাস্তব পরিসংখ্যান (জুন ১৯৯৯ পর্যন্ত)

১৯৯৯ সালের জুন পর্যন্ত দেশের সব ব্যাংক মিলিয়ে মোট ঋণ বিতরণ হয়েছে ৫৫,০৫১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২০,৭১১ কোটি লাখ টাকা

খেলাপি ঋণের খাতভিত্তিক চিত্র:

  • রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক বিশেষায়িত ব্যাংক: ১৯,২৪০ কোটি ১২ লাখ টাকা।
  • বেসরকারি ব্যাংক: ৪২,৩৪১ কোটি টাকা।
  • বিদেশি ব্যাংক: ১,২৩৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

উদাহরণ:

  • সোনালী ব্যাংক: মোট ঋণের ৫০.৯% খেলাপি ঋণ, যার পরিমাণ ৫,১৫৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৪,৭০৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা কুঋণ, যা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
  • বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো:
    • বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা – খেলাপি ঋণ ১৩.৫%
    • বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক – ৭৮.৩২%
    • রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক – ৭১.০৭%
    • কৃষি ব্যাংক – ৪৯.৩৩%

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অবস্থা:

  • অগ্রণী ব্যাংক – ৪৭.৬৩% খেলাপি ঋণ
  • রূপালী ব্যাংক – ৪৫.৩২%
  • জনতা ব্যাংক – ৪১.২৮%

এ থেকে স্পষ্ট— অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অস্তিত্ব বর্তমানে চরম ঝুঁকির মুখে, এবং নীতি-নির্ধারকদের পক্ষ থেকে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।

 

 

google news logo
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

আদর্শ ঋণ বনাম সমস্যাগ্রস্থ ঋণ [  Good Loans Vs Problem Loans ]:

আদর্শ ঋণ প্রতিটি ব্যাংকের জন্য কাম্য, কারণ এটি ব্যাংকের আর্থিক স্থিতি, মুনাফা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি করে। অপরদিকে সমস্যাগ্রস্থ ঋণ অনাকাঙ্ক্ষিত, যা ব্যাংকের মূলধন ক্ষয়, মুনাফা হ্রাস এবং সুনামহানির কারণ হতে পারে।

নীচের সারণীতে আদর্শ ঋণ ও সমস্যাগ্রস্থ ঋণের প্রধান পার্থক্যসমূহ উপস্থাপিত হলো—

ক্রমিক নংপার্থক্যের বিষয়আদর্শ ঋণ (Good Loan)সমস্যাগ্রস্থ ঋণ (Problem Loan)
অর্থ / Meaningনির্ধারিত সময়ে এবং শর্ত অনুযায়ী সম্পূর্ণ পরিশোধিত।নির্ধারিত সময়ে পরিশোধে ব্যর্থ এবং প্রায়ই খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত।
ঋণের পরিমাণ / Quantum of Loansব্যাংকের মোট ঋণের সিংহভাগই আদর্শ ঋণ।সাধারণত মোট ঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি নয়, তবে কিছু ক্ষেত্রে বেশি হতে পারে।
পরিশোধ সারণী অনুসরণ / Compliance with Repayment Scheduleশতভাগ সময়ানুবর্তিতা, অনুমোদিত ব্যতিক্রম ব্যতীত।আংশিক অনুসরণ; প্রায়ই সারণী পরিবর্তনে পূর্বানুমতি নেওয়া হয় না।
মক্কেলের ধরণ / Nature of Clientsমর্যাদাশীল, সুনামধন্য ও আর্থিকভাবে সক্ষম গ্রাহকগোষ্ঠী।অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কম সুনামধন্য ও উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গ্রাহক।
মঞ্জুরীর স্বচ্ছতা / Sanction Transparencyনীতিমালা অনুসরণ করে মঞ্জুরী দেওয়া হয়।প্রায়ই আত্মীয়, বন্ধু বা প্রভাবশালী মহলের সুপারিশে নীতিমালা উপেক্ষা করে মঞ্জুর।
শর্তাবলী / Nature of Termsসাধারণত প্রচলিত ও বাস্তবায়নযোগ্য শর্তাবলী।অনেক সময় নতুন, জটিল ও কষ্টসাধ্য শর্ত আরোপ।
ঋণ বিশ্লেষণ / Credit Analysisগভীর বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপযুক্ত গ্রাহক নির্বাচন।অপর্যাপ্ত বিশ্লেষণের ফলে অনুপযুক্ত গ্রাহক নির্বাচন।
সাহসী পদক্ষেপ / Taking Bold Stepsপ্রয়োজনে ব্যাংক যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে।রাজনৈতিক চাপ বা প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতা।
তদারকির নিবিড়তা / Supervision Intensityনিরবচ্ছিন্ন ও সুনির্দিষ্ট তদারকি।তদারকির অভাব বা শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা পালন।
১০জামানত / Securityপর্যাপ্ত ও নির্ভরযোগ্য জামানত।অপর্যাপ্ত বা অগ্রহণযোগ্য জামানত।
১১লাভক্ষতি / Profit-Loss Impactমুনাফা বৃদ্ধিকারী লেনদেন।লোকসান বৃদ্ধিকারী লেনদেন।
১২যোগাযোগ / Communicationসহযোগিতামূলক ও নিয়মিত যোগাযোগ, যেমন চিঠি, টেলিফোন বা ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ।যোগাযোগে অনীহা বা অসহযোগিতামূলক আচরণ।
১৩অর্থায়ন কাঠামো / Financing Structureপ্রতিষ্ঠানের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ মূলধন কাঠামো।দীর্ঘমেয়াদী স্থায়ী সম্পদে অযৌক্তিক বিনিয়োগ ও মূলধন-ঋণের ভারসাম্যহীনতা।
১৪প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা / Resilience to Adverse Conditionsপ্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় পূর্বপ্রস্তুতি এবং সফলতা।প্রস্তুতির অভাবে সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থতা।
১৫আইনগত ব্যবস্থা / Need for Legal Actionsমতপার্থক্য দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান; মামলা করার প্রয়োজন নেই।সমাধানে আলোচনায় অনীহা, ফলে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ অনিবার্য।

 

Leave a Comment