ড. জামান ও তাঁর তিনজন সহযোগী বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা বাংলাদেশে মেডিকেল ডিগ্রি অর্জন করে ১৯৮০ সালে সরকারি হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮২ সালে তাঁরা সৌদি সরকার কর্তৃক একটি চাকরির সুযোগ পান এবং পেশাগত উন্নয়ন ও আয়ের লক্ষ্যে সেই সুযোগ গ্রহণ করেন। তাঁরা প্রায় ১০ বছর সৌদি আরবে চাকরি করেন এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করে দেশে ফিরে আসেন।
ব্যবসায়িক উদ্যোগের সূচনা
সৌদি আরবে তাঁদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক আস্থা গড়ে ওঠে, যা দেশে ফিরে এসেও অব্যাহত থাকে। তাঁরা সৎভাবে কিছু করার ইচ্ছায় উদ্যোগ নেন। প্রাথমিকভাবে ব্যাংকার বন্ধুদের পরামর্শে ব্যবসার ধরন নির্ধারণ এবং ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন। অনেকেই পরামর্শ দেন যে, ডাক্তার হিসেবে নিজ পেশায় থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু চিকিৎসা পেশার নানান সীমাবদ্ধতা ও পরিবেশগত সমস্যার কারণে তাঁরা সে পেশায় ফিরে যেতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন।
পরবর্তীতে তাঁরা একসঙ্গে রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস ব্যবসা, বিশেষত সুয়েটার উৎপাদন ও রপ্তানি শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে তাঁদের ভালো যোগাযোগ ছিল।
ব্যাংকিং সহায়তা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন
- প্রস্তাবনা ও অনুমোদন:
১৯৯৪ সালে তাঁরা ব্যাংকের কাছে রপ্তানিমুখী মানসম্মত সুয়েটার উৎপাদন প্রকল্পের একটি প্রস্তাবনা জমা দেন। ব্যাংক গুরুত্ব সহকারে তা মূল্যায়ন করে ৭০ লাখ টাকা ঋণ অনুমোদন করে। এ প্রকল্পের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল বছরে ৬০,০০০ ডজন সুয়েটার। প্রকল্পটি একটি ভাড়াকৃত ভবনে স্থাপন করা হয় এবং ব্যাংকের কাছে প্রতিশ্রুত সম্পত্তি জামানত হিসেবে প্রদান করা হয়। - কার্যক্রম শুরু:
তাঁরা সময়মতো যন্ত্রপাতি আমদানি ও স্থাপন করে ১৯৯৫ সালে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করেন। ব্যাংক ঋণটি ১০টি অর্ধ-বার্ষিক কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য ছিল। - ব্যবসার সম্প্রসারণ:
তাঁরা ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফা দিয়ে নিজস্ব তহবিলেই অতিরিক্ত ৬০,০০০ ডজন উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। একইসঙ্গে তাঁরা নিয়মিতভাবে ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করতে থাকেন এবং সময়মতো সব লেনদেন সম্পন্ন করেন।
ব্যাংকের প্রতিক্রিয়া
এই সফল ব্যবস্থাপনা ও স্বচ্ছ আর্থিক লেনদেনের জন্য ব্যাংক অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয় এবং তাঁদের কাছে বিদ্যমান ইউনিটে বা নতুন প্রকল্পে আরও অর্থায়নের প্রস্তাব দেয়। তবে উদ্যোক্তারা সে প্রস্তাবে আগ্রহ দেখাননি।
বর্তমানে এম/এস ডক্টরস সুয়েটারস লিমিটেড বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ সুয়েটার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে এবং ব্যাংকিং খাতে তাঁদের পরিচিতি অত্যন্ত ইতিবাচক।
???? বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন: ব্যবসার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক নির্ধারণ
আপনি যদি একজন ব্যবসা প্রশাসনের শিক্ষার্থী (MBA/M.Com) অথবা একজন ব্যাংক নির্বাহী হন, তবে নিচের বিষয়গুলোর ভিত্তিতে কেসটি বিশ্লেষণ করুন:
১. দক্ষ ব্যবস্থাপনা (Efficient Management)
- সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন
- উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণ করা
- নিয়মিতভাবে ব্যাংক কিস্তি পরিশোধ
- সুনাম অর্জনের মাধ্যমে বাজার সম্প্রসারণ
মূল প্রশ্ন:
→ এই ব্যবসায়িক সাফল্যের পেছনে ব্যবস্থাপনার কী কী সিদ্ধান্ত কার্যকর ছিল?
২. পর্যাপ্ত মূলধনের প্রাপ্তি (Availability of Capital/Fund)
- প্রবাসে দীর্ঘদিন কাজ করে সঞ্চিত অর্থ
- ব্যাংকের কাছ থেকে যথাসময়ে প্রাপ্ত ঋণ
- ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফার পুনঃবিনিয়োগ
মূল প্রশ্ন:
→ মূলধনের সঠিক ব্যবহার ও বিনিয়োগ কতটা কার্যকরভাবে সম্পন্ন হয়েছে?
৩. ঋণ পরিশোধের সদিচ্ছা (Willingness to Repay)
- সময়মতো ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ
- অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণে অনাগ্রহ, যাতে অতিরিক্ত দায় তৈরি না হয়
মূল প্রশ্ন:
→ উদ্যোক্তাদের আর্থিক দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা কতটা প্রমাণিত?
৪. উদ্যোক্তাদের সততা (Honesty of the Borrowers)
- ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা
- অর্থের যথাযথ ব্যবহার
- ব্যবসায়িক মুনাফা থেকে নিজেরাই বিনিয়োগ করেছেন, অতিরিক্ত ঋণের উপর নির্ভর করেননি
মূল প্রশ্ন:
→ তাঁদের সততা কিভাবে ব্যাংকের আস্থা অর্জনে সহায়ক হয়েছে?

এই কেসটি বাংলাদেশের উদ্যোক্তা সংস্কৃতিতে একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এতে আমরা দেখতে পাই—সততা, পেশাগত বন্ধন, সঠিক পরিকল্পনা এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কীভাবে একটি সফল শিল্প উদ্যোগ গড়ে তোলা সম্ভব।
এটি ব্যাংক ও ব্যবসা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা—সঠিক প্রস্তুতি, পুঁজির যথাযথ ব্যবহার এবং ঋণ পরিশোধে দায়বদ্ধতা থাকলে যে কোনও উদ্যোগ সফলতা পেতে পারে।