[ADINSERTER AMP] [ADINSERTER AMP]

ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ কি ও এর প্রাসঙ্গিকতা

ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ বলতে এমন একটি প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যার মাধ্যমে একটি ব্যাংকের ব্যবসায়িক পদ্ধতি, পরিচালনা এবং দৈনন্দিন কার্যক্রম একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর অধীনে পরিচালিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো:

  • জনগণকে নিরাপদ ব্যাংকিং সেবা প্রদান,
  • আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ,
  • আর্থিক ও ঋণ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা বজায় রাখা, এবং
  • গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপর গণআস্থা (Public Confidence) প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করা।

এমন একটি ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলা হয় যাতে ব্যাংকসমূহ দায়িত্বশীলভাবে পরিচালিত হয় এবং দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখতে পারে।

 

???? বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি

Grantier (1990):

“Banking regulation or supervision is to be seen from its prudential aspects — the rules and techniques that aim to protect the depositors through which the soundness of the financial sector is ensured, i.e., its solvency, liquidity, and profitability.”

???? মূল ভাবার্থ: ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ এমন একটি নিয়ম-কানুন ও প্রযুক্তির সমষ্টি, যা আমানতকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং যার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের সলভেন্সি (দায় মেটানোর ক্ষমতা), লিকুইডিটি (তাৎক্ষণিক অর্থপ্রাপ্তি সক্ষমতা) এবং লাভজনকতা বজায় থাকে।

Heller (1991):

ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য একটি ব্যাংকের কার্যক্রম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শন করা।

???? মূল ভাবার্থ: এটি একটি তত্ত্বাবধানমূলক ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে ব্যাংক পরিচালনার আইনগত দিক নিয়মিতভাবে যাচাই করা হয়।

Henderson (1993):

“The main focus of regulation has been to stabilize the financial system against systemic risks brought on by the failure of individual banks.”

???? মূল ভাবার্থ: ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের মূল উদ্দেশ্য হলো আর্থিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল রাখা এবং কোনো একটি ব্যাংকের পতনের কারণে যেন গোটা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে, তা নিশ্চিত করা।

Bank of England (Banking Act Report, 1996/97):

“The primary objective of banking regulation and supervision is to monitor whether banks discharge their responsibilities effectively — thereby protecting depositors’ interests and strengthening public confidence in the banking system.”

???? মূল ভাবার্থ: ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নজরদারি নিশ্চিত করা, যাতে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষিত হয় এবং গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপর জনসাধারণের আস্থা বৃদ্ধি পায়।

উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলোর ভাষাগত পার্থক্য থাকলেও মূল ভাব অভিন্ন — ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ বলতে বোঝায় এমন একটি নিয়ন্ত্রিত ও পর্যবেক্ষণাধীন ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়:

  • আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা,
  • ব্যাংকিং খাতের দক্ষতা ও স্থিতিশীলতা,
  • ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক খাতের দীর্ঘস্থায়ী শক্তিমত্তা।

 

ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদানসমূহ

উপাদানকার্যাবলি
লাইসেন্স প্রদাননতুন ব্যাংক স্থাপনে অনুমোদন ও শর্ত নির্ধারণ
মূলধন রিজার্ভ বিধানন্যূনতম মূলধন ও রিজার্ভের পরিমাণ নির্ধারণ
ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণঋণ ঝুঁকি, বাজার ঝুঁকি, লিকুইডিটি ঝুঁকি প্রভৃতির তদারকি
আইনগত তত্ত্বাবধানসংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন
মনিটরিং সুপারভিশনব্যাংকের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ ও অডিট

 

সুতরাং, ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ একটি সুসংগঠিত ও আইনভিত্তিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের সুষ্ঠু পরিচালনা, আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষা, আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং গণআস্থা নিশ্চিত করা হয়। এটি কেবল একটি প্রশাসনিক প্রয়োজন নয়, বরং একটি টেকসই অর্থনৈতিক কাঠামো গঠনের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।

 

ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের প্রাসঙ্গিকতা:

যে কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মতো ব্যাংক ব্যবসায়েও নিয়ন্ত্রণ থাকা অপরিহার্য। কারণ নিয়ন্ত্রণবিহীন ব্যাংকিং কার্যক্রম বহু সময়েই জনস্বার্থবিরোধী রূপ নিতে পারে। লাভের আশায় অনিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়ীগণ প্রায়শই এমন সব কার্যক্রমে লিপ্ত হন, যা বৃহত্তর জনস্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ব্যবসায়ীদের আত্মস্বার্থ সর্বাধিক করার প্রবণতা আদিকাল থেকেই বিদ্যমান ছিল।

 

???? প্রাচীন উদাহরণ: হাম্মুরাবির আইন

খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ সালে ব্যবিলনের রাজা হাম্মুরাবি জনস্বার্থে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি ৩০০টিরও বেশি আইনধারা বিশাল ৮ ফুট উঁচু পাথরের দেয়ালে খোদাই করান, যেখানে মৃত্যুদণ্ডসহ নানা শাস্তির বিধান ছিল ব্যবসায়িক অনিয়ম রোধে। এটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা।

“A thing may look specious in theory,
and yet be ruinous in practice,
a thing may look evil in theory,
and yet be in practice excellent.”

Burke Edmund

এই উদ্ধৃতিটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তাত্ত্বিকভাবে কোনো কিছু ভালো বা খারাপ মনে হলেও তার বাস্তব প্রয়োগ ভিন্ন ফল বয়ে আনতে পারে। তাই ব্যাংকিংয়ের মতো স্পর্শকাতর খাতে বাস্তবিক নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করা আবশ্যক।

 

????️ ব্যাংক ব্যবসার স্পর্শকাতরতা

ব্যাংক ব্যবসা অন্যান্য ব্যবসার তুলনায় অধিক স্পর্শকাতর। এর মূল কারণ হচ্ছে, ব্যাংকগুলো ব্যক্তিগত সঞ্চয়, ঋণ ও আর্থিক ব্যবস্থার মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। ১৯১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম (Federal Reserve System) প্রতিষ্ঠার পূর্বে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কার্যত নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পরিচালিত হতো।

???? ঐতিহাসিক পটভূমি: বিশ্ব মহামন্দা

এই অপ্রতুল নিয়ন্ত্রণের ফলেই ত্রিশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ব মহামন্দা (Great Depression) দেখা দেয়। ব্যাংক মালিকদের সীমাহীন লাভলিপ্সা এবং ফাংসাত্বক (destructive) প্রতিযোগিতার ফলে হাজার হাজার ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায়। এতে সাধারণ জনগণের আমানত ধ্বংস হয় এবং আর্থিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

 

???? গণতান্ত্রিক চাহিদা ও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণদাবি উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই আমানতকারীদের সুরক্ষা, জনগণের আর্থিক নিরাপত্তা এবং আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ব্যাংক ব্যবসায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজনীয়।

???? পাঠের কাঠামো

আমরা এই পাঠে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম নিম্নোক্ত দুই ভাগে আলোচনা করা হয়েছে:

ক. সাধারণ আলোচনা

  • ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের অর্থ
  • আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো
  • ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

খ. বাংলাদেশের ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা

  • বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা
  • ব্যাংক কোম্পানি আইন
  • নিয়ন্ত্রক নীতিমালা ও বাস্তবায়ন

 

google news logo
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

ব্যাংক ব্যবসায় নির্ভর করে গণ আস্থার উপর। ব্যাংক জনগণের নিকট থেকে আমানত সংগ্রহ করে এবং তা জনগণের মধ্যে ঋণ হিসেবে প্রদান করে। কিন্তু ব্যাংক যদি জনগণের আমানত ফেরৎ দিতে ব্যর্থ হয় ও জনগণের ঋণের উপর অধিক সুদ ধার্য করে তাহলে উক্ত বাকের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। ফলে গোটা ব্যাংকের প্রতি আগ্রহ বিনষ্ট হয় এবং অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসে। কখনও কখনও তা মহামারী বা মহামন্দা আকারে দেখা দেয়।

সুতরাং আর্থিক ও অর্থনৈতিক শৃংখলা বজায় রাখার জন্য ব্যাংকিং ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। ব্যাকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি অর্থনীতির আর্থিক ও এ সংক্রান্ত কার্যাবলী পরিচালিত হয়ে থাকে। একটি দেশের মুদ্রার আভ্যন্তরীণ ও বহিঃ মূল্য সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রণ, অর্থসরবরাহ ও ঋণ ব্যবস্থার পরিচালনা ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমেই সম্পাদিত হয়। জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান খাত তথা সঞ্চয় বৃদ্ধি ও প্রবাহ ব্যাংকিং পদ্ধতিতেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। ফলশ্রুতিতে জাতীয় অর্থনীতির খাত তথা ব্যাংকিং খাতকে সুব্যবস্থিত ও সুনিয়ন্ত্রিত রাখার প্রক্রিয়া কার্যত: ত্রয়োদশ শতাব্দী হতে চলে আসছে। তবে ব্যাংকিং ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণের এ ধারা ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে আরও ব্যাপকতা লাভের মাধ্যমে উনবিংশ শতাব্দীতে এসে পূর্ণতা লাভ করে।

Leave a Comment