ব্যাংকিং কেস স্টাডি নং ৫৬ : এম/এস সুরমা হানি প্রসেসিং লিমিটেড

মো. হাসানুজ্জামান চৌধুরী খুলনা শহরে কাপড়, সিমেন্ট ও রডের পাইকারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সুন্দরবন এলাকায় প্রাকৃতিক মধুর সহজলভ্যতা বিবেচনায় তিনি একটি মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ (Honey Processing) ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। ১৯৮২ সালে তিনি ব্যাংকের কাছে একটি প্রস্তাবনা দাখিল করে আর্থিক সহায়তা চান।

তিনি নিজের পরিবার-ভিত্তিক Private Limited Company গঠন করেন। ব্যাংক প্রকল্পের সম্ভাব্যতা বিবেচনা করে ৪০ লক্ষ টাকা ঋণ মঞ্জুর করে, যেখানে Debt-Equity Ratio নির্ধারণ করা হয় ৭০:৩০।

প্রকল্প বাস্তবায়ন ও যন্ত্রপাতি সংক্রান্ত সমস্যা

• যন্ত্রপাতি আমদানি ও নির্মাণ:
  উদ্যোক্তারা ১৯৮২ সালে জার্মানি থেকে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি আমদানি করেন এবং নিজেদের মূলধন দিয়ে কারখানা নির্মাণ করেন।
• অপ্রয়োজনীয় বিনিয়োগ:
  প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ব্যাংকের প্রকৌশলী দেখতে পান উদ্যোক্তারা মূল কারখানা ভবনের পাশাপাশি অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে অফিস ভবন ও অতিথিশালা (Guest House) নির্মাণ করেছেন, যা প্রকল্পের জন্য অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় সম্পদ (Unproductive Asset) হিসেবে বিবেচিত।
• যন্ত্রপাতি স্থাপনায় বিলম্ব:
  আমদানিকৃত যন্ত্রপাতি ১৯৮২ সালে প্রকল্পস্থলে পৌঁছালেও, যন্ত্র প্রস্তুতকারক কোম্পানির অবহেলার কারণে তা ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও, তারা সময়মতো কারিগরি সহায়তা ও স্টাফ ট্রেনিং দেয়নি।

উৎপাদন সমস্যা ও পরিচালনার দুর্বলতা

• আন্তর্জাতিক মানের ঘাটতি:
  যন্ত্রপাতি স্থাপনের পর দেখা যায়, কাঁচা মধুতে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকায় প্রক্রিয়াজাত মধু আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী হয়নি।
• ব্যাংকের কারিগরি হস্তক্ষেপ:
  ব্যাংক নিযুক্ত প্রকৌশলী সমস্যাগুলোর جزবীয় সমাধান করেন এবং ১৯৮৬ সালে মিলটি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে।
• মূলধনের ঘাটতি:
  এর মধ্যেই কোম্পানির মোট দায় দাঁড়ায় ৮০ লক্ষ টাকা, এবং উৎপাদন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় Working Capital জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়।
• ঋণ পুনঃনির্ধারণ:
  ১৯৮৭ সালে ব্যাংক কোম্পানির সুদ মওকুফ করে এবং ১০ লক্ষ টাকা ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ প্রদান করে।

ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ও প্রকল্প ব্যর্থতা

• মূল উদ্যোক্তার মৃত্যু:
  প্রধান উদ্যোক্তার আকস্মিক মৃত্যু হলে তাঁর পুত্ররা ব্যবস্থাপনায় আসেন, কিন্তু তারা প্রকল্প চালাতে ব্যর্থ হন।
• ব্যাংকের হস্তক্ষেপ:
  ব্যাংক নিজেই যৌথভাবে প্রকল্প পরিচালনার চেষ্টা করে, কিন্তু আবারও ব্যর্থ হয়।
• গুদামজাত পণ্যের নষ্ট হওয়া:
  কাঁচা ও প্রক্রিয়াজাত মধু ত্রুটিপূর্ণ সংরক্ষণ ব্যবস্থার কারণে নষ্ট হয়ে যায়।
• বর্তমান অবস্থা:
  গত ১০ বছর ধরে প্রকল্পটি বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে মোট বকেয়া ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭.৫০ কোটি টাকা, এবং প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকে এক টাকাও উদ্ধার হয়নি।
• ব্যাংক আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং সংবাদপত্রে নিলামের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে, কিন্তু এখনো কোনও আগ্রহী ক্রেতা এগিয়ে আসেননি।

???? বিশ্লেষণমূলক প্রশ্ন: প্রকল্প ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান

একজন ব্যবসা প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থী (MBA/M.Com) বা ব্যাংক নির্বাহী হিসেবে নিচের বিষয়গুলোর আলোকে কেসটি বিশ্লেষণ করুন:

১. ব্যবসার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অভাব

(Incompetence and Inexperience in the Line)

• উদ্যোক্তার অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন খাতে (খুচরা/পাইকারি পণ্য)
• মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ ও খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রযুক্তিগত জ্ঞান ছিল না

মূল প্রশ্ন:
→ একজন উদ্যোক্তা কতটা প্রস্তুতি ছাড়া নতুন শিল্প খাতে বিনিয়োগ করলে কী ধরনের সমস্যা হয়?

২. ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতি ও কারিগরি সহায়তার অভাব

(Faulty Machinery and Delayed Technical Support)

• যন্ত্র নির্মাতারা সময়মতো যন্ত্র স্থাপন ও প্রশিক্ষণ দেননি
• আর্দ্রতার মান নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তিগত দুর্বলতা ছিল

মূল প্রশ্ন:
→ যন্ত্রপাতি কেনার আগে উদ্যোক্তা বা ব্যাংক কি যথাযথ যাচাই করেছিল?

৩. ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের ঘাটতি

(Shortage of Working Capital)

• প্রাথমিক উৎপাদনের পর কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার মতো মূলধন ছিল না
• ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল জোগাড়ে ব্যর্থতা প্রকল্পের ধারাবাহিকতা নষ্ট করে

মূল প্রশ্ন:
→ শুধুমাত্র মূলধনী (Capital Expenditure) বিনিয়োগ যথেষ্ট নয়—চলমান ব্যয়ের জন্য পূর্বপরিকল্পনা ছিল কি?

৪. নিম্নমানের কাঁচামাল

(Quality of Raw Materials)

• সুন্দরবন অঞ্চলের কাঁচা মধুতে বেশি আর্দ্রতা থাকায় প্রক্রিয়াজাত পণ্য আন্তর্জাতিক মানে উত্তীর্ণ হয়নি

মূল প্রশ্ন:
→ কাঁচামাল যাচাই না করে শিল্প স্থাপন কতটা বিপজ্জনক?

৫. ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন

(Change of Management)

• অভিজ্ঞ উদ্যোক্তার মৃত্যুর পর পরবর্তী প্রজন্ম প্রকল্প চালাতে ব্যর্থ হয়

মূল প্রশ্ন:
→ উত্তরাধিকার পরিকল্পনার অনুপস্থিতি ব্যবসা ধারাবাহিকতায় কী ধরনের প্রভাব ফেলে?

৬. অপ্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ

(Increase of Unproductive Assets)

• অফিস ও গেস্ট হাউসের জন্য অতিরিক্ত ব্যয়, যা প্রকল্পের উৎপাদনে কোনও অবদান রাখেনি

মূল প্রশ্ন:
→ মূল প্রকল্প ব্যয়ের তুলনায় অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের অনুপাত কতটা ছিল?

এই কেস স্টাডিটি প্রমাণ করে, শুধুমাত্র আর্থিক সহায়তা বা কাঁচামাল সহজলভ্য হলেই একটি শিল্প উদ্যোগ সফল হয় না। প্রকল্পের পরিকল্পনা, প্রযুক্তি নির্বাচন, পরিচালন দক্ষতা ও বাজার বিশ্লেষণ—সবই সমান গুরুত্বপূর্ণ। Surma Honey Processing Ltd. একটি সম্ভাবনাময় উদ্যোগ ছিল, যা উদ্যোক্তার অজ্ঞতা, কারিগরি দুর্বলতা এবং ব্যবস্থাপনায় ধারাবাহিকতার অভাবে সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

এটি ব্যাংকারদের জন্যও সতর্কতা স্বরূপ—due diligence, technical feasibility, এবং post-loan monitoring না থাকলে ব্যাংকের অর্থও ঝুঁকিতে পড়ে।